ফেনী: মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী মোস্তফার জেরা শেষ হয়েছে। জেরা শেষে অধ্যক্ষ সিরাজের কুকীর্তির বর্ণনা দিলেন নৈশপ্রহরী মোস্তফা।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে মোস্তফার জেরা করা হয়।
এ বিষয়ে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী মোস্তফা আদালতকে জানান- অধ্যক্ষ সিরাজ ইতিপূর্বে অনেক ছাত্রীর ইজ্জত নষ্ট করেছেন। রাফির ঘটনার কয়েক মাস পূর্বে মোস্তফা মাদ্রাসার জরুরি কাজে অফিস কক্ষে প্রবেশ করে দেখেতে পান, অধ্যক্ষ সিরাজ এক ছাত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছে।
তিনি বলেন, ‘তিনি এ দৃশ্য দেখে দ্রুত অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েন। পরে অধ্যক্ষ সিরাজ তার চোখে দেখা এ ঘটনা কাউকে জানালে তাকে পুলিশ দিয়ে চুরির মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন।’
আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু জানান, আসামিদের জেরা শেষ হলে নতুন সাক্ষী হিসেবে রাফি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কেরোসিন বিক্রেতা সোনাগাজীর ভূঞা বাজারের জসিম উদ্দিন, সোনাগাজীর কাপড় ব্যবসায়ী বোরকা বিক্রেতা লোকমান হোসেন ও বোকরা সরবরাহকারী দোকন কর্মচারী হেলাল উদ্দিনের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রোববার দিন ধার্য রাখা হয়েছে। আসামি পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু ও কামরুল হাসানসহ ১৬ আসামির পক্ষে প্রায় ২০ জন আইনজীবী মোস্তফাকে জেরা করেন।
সিনিয়র আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু জানান, নৈশপহরী মোস্তফা যে সব সাক্ষ্য আদালতে দিয়েছে, তার কোনোটাই সঠিক নয়। মোস্তফার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার বিভিন্ন মালামাল চুরিসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা বিভিন্ন সময় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় তার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে মোস্তফা মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে নুসরাত হত্যা মামলার সব আসামিকে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে নুসরাতের মাদ্রাসার নৈশপহরী মো. মোস্তফার সাক্ষ্য শেষে আসামিদের আইনজীবীদের জেরা শুরু হয়।
গত ২৭ জুন মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। যা শেষ হয় রোববার। গত সোম ও মঙ্গলবার নুসরাত জাহান রাফির বান্ধবী নিশাত সুলতানা ও সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ফূর্তির সাক্ষগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। বুধবার পিয়ন নুরুল আলমের জেরা করা হয়েছে।
অভিযোগ গঠনের ছয়দিনের মাথায় ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে বাদীপক্ষের তিনজন সাক্ষীকে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য উপস্থাপন করা হয়। ২০ জুন সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেন আদালত। মামলার চার্জশিট জমা দেয়ার আগে সাতজন সাক্ষী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা কেন্দ্রে গেলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতহানির মামলা তুলে না নেয়ায় তাকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে- মৃত্যু শয্যায় এসব কথা নুসরাত বলে গেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফেনীর পরিদর্শক শাহ আলম আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগপত্রের ১৬ আসামি হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল।
এ মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করে পিবিআই। আদালত তা অনুমোদন করেন। এছাড়া যৌন হয়রানির মামলার পর নুসরাতের জবানবন্দি গ্রহণের সময় ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে সাইবার অপরাধ আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।